প্যারাসিটামল খাবেন না। জ্বর হলে বাচ্চাদের প্যারাসিটামল দিয়ে কোনাে লাভ হয় বলে কোনাে প্রমাণ নেই II অ্যালােপ্যাথি কেন চলে? ডা. শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র - suexpress

Header Ads

প্যারাসিটামল খাবেন না। জ্বর হলে বাচ্চাদের প্যারাসিটামল দিয়ে কোনাে লাভ হয় বলে কোনাে প্রমাণ নেই II অ্যালােপ্যাথি কেন চলে? ডা. শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র



অ্যালােপ্যাথি কেন চলে?

ডা. শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র


প্যারাসিটামল
প্যারাসিটামল

জুর হলে জ্বর কমানাের ওষুধ, বমি হলে বমি কমানাের ওষুধ, ডায়রিয়া হলে পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ, আর কোষ্ঠকাঠিন্যে পায়খানা পাতলা হওয়ার ওষুধ, কাশি হলে কাশির সিরাপ দিয়ে কাশি বন্ধ করে দেওয়া একেই বলে অ্যালােপ্যাথি চিকিৎসা। অ্যালাে' কথাটার মানে হল বিপরীত আর ‘প্যাথি’ মানে রােগ। রােগের যা লক্ষণ তার বিপরীত ক্রিয়া করে এমন ওষুধ দেওয়াকে অ্যালােপ্যথিক চিকিৎসা বলে। যে ডাক্তার চোখ কান বন্ধ করে জুর হলে জুর কমানাের ওষুধ, কাশি হলে কাশি বন্ধের ওষুধ, আর বমি হলে বমি বন্ধ করার ওষুধ দেন তাকে অ্যালােপাথিক ডাক্তার বলব। অ্যালােপাথি অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও নিন্দনীয়।

MBBS, MD
MBBS, MD 
MBBS, MD ডিগ্রীধারী ডাক্তার বাবুরা কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে অ্যালােপ্যাথি পড়েন না। তারা যা পড়েন সেটা হল আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান (modern medicine বা scientific medicine)

আক্ষেপের বিষয় এই যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়েও অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও নিন্দনীয় অ্যালােপ্যাথিক প্র্যাকটিস চালিয়ে যান, যা ভাল হাতুড়ে ডাক্তারেরাও করতে লজ্জা পাবেন। মনে করুন একজন এক বছরের শিশুর দু'দিন ধরে রােজ কয়েকবার পাতলা পায়খানা আর ২-৩ বার করে বমি করছে। বাচ্চাটাকে বমি বন্ধ করার ওষুধ দিতে হবে কি? কোনাে প্রয়ােজন নেই, কারণ দিনে কয়েকবার বমি করলে বাচ্চার কোনাে ক্ষতি হয় না। শুধু তাকে বারে বারে অল্প অল্প করে খাবার ও পানীয় দিতে হবে। একসঙ্গে বেশি খাওয়ালে বমি হবে। বমির ওষুধ দেওয়াটা শুধু অপ্রয়ােজনীয় অর্থ নষ্টই নয়, এর থেকে মারাত্মক ক্ষতিও হতে পারে যেমন
domperidone (যা বাজারে Domstal নামে পাওয়া। যায়), metoclaprrimide (যা বাজারে Reglan নামে পাওয়া যায়) নামক বমির ওষুধ দুটো থেকে বাচ্চার ঘাড় ও শরীর শক্ত হয়ে যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে আন্ত্রিকে বমির ওষুধ দিয়ে বাচ্চার কোনাে লাভ হয় না। উল্টে নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াৰ সম্ভাবনা। তাই বমির ওষুধ না দেওয়াই ভালাে। আমেরিকার শিশু বিশেষজ্ঞদের সংগঠন (American Academy of Pediatrics, AAP) আন্ত্রিকে বমির ওষুধ দিতে বলেন। কানাডার শিশু বিশেষজ্ঞদের। সংগঠনও (Canadian Society of Pediatrics) শিশুদের আন্ত্রিকে বমির ওষুধ দেওয়া চলবে না বলে মন্তব্য করেছে। ইটালিতে ১৬ বছরের কম বয়েসীদের metocloprmide দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইদানীং অনেক শিশুবিশেষজ্ঞ অনডানসেটুন (ondansetron) নামে একটা সিরাপ বাচ্চাদের আন্ত্রিকে বমি কমাতে প্রায়ই ব্যবহার করছেন। এই ওষুধটা বাজারে Ondem, Zofer ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। তবু এরও সাধারণত প্রয়ােজন হয় না। যদি বার বার বমি হয় (প্রতি ঘন্টায় তিন বার বা তার বেশি এবং একনাগাড়ে) এবং তার ফলে ORS খাওয়ানাে অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে এই ওষুধের একটা ডােজ দিলে অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার বমি বন্ধ হয় এবং তাকে ORS খাওয়ানাে সম্ভব হয়। তার ফলে বাচ্চাকে হাসপাতালে বা নার্সিং হােমে ভর্তির দরকার কমে, মা বাপের পয়সা বাঁচে। তাই কোনাে ডাক্তার কালেভদ্রে তাঁর চেম্বারে বা আউটডােরে ঘন ঘন বমি করছে এমন দু একটা বাচ্চাকে ondansetron-এর একটা ডােজ দিয়ে থাকলে সেটাকে অযৌক্তিকবলা যায় না। তবে মনে রাখতে হবে এর যথেচ্ছ প্রয়ােগ যেন না হয়। আর এক দিনে কয়েকবার বা ২৩ দিন ধরে এই ওষুধ দিলে বাচ্চার বমি কমলেও ডায়রিয়া বেড়ে যায়। তাই ডাক্তারবাবুরা খুব সীমিত ক্ষেত্রে একবার মাত্র ondansetron ওষুধটা দিলেও দিতে পারেন। বেশি বার দিলে ক্ষতি হবে। আন্ত্রিকে পাতলা পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ খাবেন না। পাতলা মলের সঙ্গে পেটের বিষ বেরিয়ে যাওয়াই ভাল। তারপর পায়খানা বিনা ওষুধে নিজেই বন্ধ হবে। ডায়রিয়া হলে বাচ্চাকে চাল, ডাল, ঘি বা মাখন মিশিয়ে খিচুড়ি করে খাওয়ান, ফলের রস দেবেন না, গ্লুকোজ জল দেবেন না। তাতে ডায়রিয়া বাড়ে। এক গ্লাস জলে দু চামচ চিনি এবং এক চিমটে নুন মিশিয়ে ORS তৈরি করে খাওয়ান। সাধারণ জল, ডাবের জল দিতে পারেন। ফলের মধ্যে কলা দিতে পারেন। কাশি হলে কাশি বন্ধের ওষুধ কেউ খেতে চান কি? স্বর্গীয় ডাক্তার ওম প্রকাশ ঘাই মহাশয় তার শিশু চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইয়ে সর্দি কাশিতে কাশীর সিরাপ দিতে নিষেধ করেছেন। ওই বই পড়ে প্রতি বছর শত শত ছেলে পাশ করে ডাক্তার হচ্ছে আর তারপরই ফটাফট কাশির সিরাপ লেখা শুরু করে দিচ্ছে। কাশি উপকারী এই জন্য যে, এর ফলে শ্বাসনালী থেকে দূষিত পদার্থগুলাে বেরিয়ে যায়। তাছাড়া অ্যান্টিহিস্টামিনিক ওষুধ দিলে শ্বাসনলীর নিঃসরণ (secretion) শুকিয়ে যায়, একে অনেকে সর্দি বসে যাওয়া বলেন। এর ফলে দম আটকানাে কাশি, বুকে সাঁই সাঁই আওয়াজ (wheezing) ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়ে নিউমােনিয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সর্দিকাশির সঙ্গে অল্প জ্বর হতে পারে যা সাধারণত ৩ দিনের মধ্যে নিজেই কমে যায়। কাশি সাধারণত এক সপ্তাহ বা দশ দিনের মধ্যে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। সর্দিকাশি হলে কাশি বন্ধের ওষুধ বা কাশির সিরাপ দেওয়া তাই কুচিকিৎসা, অ্যালােপ্যাথি। আমি সর্দিকাশিতে বেশি করে জল খাই, গরম জলের ভাপ নি। গলা খুশখুশ করলে আদা আর মধু খাই। কাশির সিরাপ বিনা পয়সায় পেলেও খাই না। অনেক কাশির সিরাপে মদ এবং অন্যান্য নেশার দ্রব্য থাকে। ১০৪-১০৫ ডিগ্রি জ্বরেও কোনাে ক্ষতি হয় না। তবু অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকেও দেখা যায় ১০০ ডিগ্রি এর উপরে জ্বর হলেই রুগীকে প্যারাসিটামল খেয়ে জ্বর কমাতে বলেন। এটা ঠিক নয়। 

তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেই অনেকে প্যারাসিটামল খান, কেউ কেউ খান বিনা জ্বরেই বা জ্বর না মেপেই। জ্বর উপকারী, জ্বর রােগপ্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়ায়, রােগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। তাই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে জ্বর হলে ব্যাকটেরিয়া মারার ওষুধ (antibiotics) খান,

বেশি করে জল খান, প্যারাসিটামল খাবেন না। জ্বর হলে বাচ্চাদের প্যারাসিটামল দিয়ে কোনাে লাভ হয় বলে কোনাে প্রমাণ নেই। প্রত্যেক ডাক্তরবাবুর উচিত জ্বরে প্যারাসিটামলের ব্যবহার একেবারে কমিয়ে আনার জন্য গণ আন্দোলন গড়ে তােলা। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রধান ধারাটাকে অ্যালােপ্যাথি আখ্যা দিয়েছিলেন স্যামুয়েল হ্যানিমান। কাজটা তিনি ঘােরতর অন্যায় করেছিলেন। কারণ মূলধারার চিকিৎসা বিজ্ঞান মানে অ্যালােপ্যাথি নয়, রােগের লক্ষণ কমানাের ওষুধ দেওয়া নয়। MBBS, MD ডাক্তারবাবুদের অ্যালােপ্যাথ বললে তাদের অপমান করা হয়। তাদের আধুনিক Torreta (practitioners of modern medicine) বলা উচিত। অথচ গভীর আক্ষেপের সঙ্গে আমি লক্ষ্য করেছি যে অনেক বিশেষজ্ঞ (specialist) এবং অতি বিশেষজ্ঞ (super Specialist) ডাক্তারও জানেন না যে তাদের বিদ্যাটাকে অ্যালােপ্যাথি বলে না, বলে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাশাস্ত্র। তাই অ্যালােপ্যাথ বললে যে হাতুড়ে বলার চেয়েও বেশি গালি দেওয়া হয় সেটা তাঁরা বােঝেন না। আরও পরিতাপের বিষয় এই যে তাঁরা নিশ্চিন্তে অ্যালােপ্যাথিক প্র্যাকটিশ চালিয়ে যান। জনৈক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বন্ধুকে বলছিলুম, “তুই কেন জুরে জুরের ওষুধ, বমিতে বমির ওষুধ দিস?” সে বলল, “তবে কি তুই বমিতে জুরের ওষুধ, আর জুরে বমির ওষুধ দিতে বলছিস?” তখন তাকে বুঝিয়ে বললাম যে এতাে অ্যালােপ্যাথি, আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নয়। বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নাল থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। সব শুনে সে বলল, “এমন করলে তাের প্র্যাকটিশ চলবে না। তুই দিনরাত সমাজমনস্কতা, বিজ্ঞানমনস্কতার কথা বলিস। কিন্তু সমাজের কিছুই তুই বুঝিস না। ভারতে প্র্যাকটিশ করবি, আর আমেরিকা। ইতালি থেকে উদ্ধৃতি দিবি।” আমি বললুম, “কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার নামে অ্যালােপ্যাথি করি কি করে?” সে বলল, “প্র্যাকটিশ করতে হলে সেটা করতে হবে। রুগী তাের লেকচার শুনতে চায় না। তারা ওষুধ চায়। তােকে তাই দিতে হবে। তাতে ক্ষতি হলে হবে।”

এদেশে অ্যালােপ্যাথি কেন চলে বৃদ্ধিমান পাঠকপাঠিকাদের তা আরও বুঝিয়ে বলার দরকার আছে কি?




তথ্যসূত্র - :
1. A Rivaz, Paediatric Gastroenterology and
Hepatology, 3rd edition, Paras Medical Publisher.
2. Journal of Paediatric Gastroenterology and
Nutrtion, Sept. 2006, Vol.13, Issue 3
3. Om Prakash Ghai, Vinod K Paul, Arvind Bagga, Essential Paediatrics, 4th edition
4. Bull. World Health Organ., 2003, 81 (6) 3632
5. Shan, P, 1995 “Paracetamol Use in Children”, Australian Prescriber, 18, 233 4 hrrp//www.austrlianprescriber.com. magazine/18/2/33/5/A.
বাঁকুড়ার পাচাল গ্রাম থেকে প্রকাশিত চেতনা থেকে পুনর্মুদ্রিত।

No comments

Powered by Blogger.